ইতিহাস
ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের কারণ কি ছিল?
ফরাসি সম্রাট অষ্টাদশ লুই এর মৃত্যুর পর(১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে) তার ভাই সম্রাট দশম চার্লস (১৮২৪-৩০
খ্রিস্টাব্দ) ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন।
তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল দশম চার্লসের বিরুদ্ধে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব ঘটে। এই বিপ্লবের বিভিন্ন
কারণ ছিল-
মধ্যপন্থা নীতি বাতিল: পূর্ববর্তী সম্রাট অষ্টাদশ লুই -এর মধ্যপন্থা নীতি বাতিল করে দশম চার্লস ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র , অভিজাততন্ত্র ও ক্যাথলিক গির্জার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করেন। বহু সাংবাদিককে কারারুদ্ধ করা
হয়।
ধর্মীয় উদ্যোগ: দশম চার্লস ধর্ম বিরোধী আইন (১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ) পাস করে - (i) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর গির্জার প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠা করেন।
(ii)
গির্জার বিরুদ্ধে সমালোচনার অধিকার কেড়ে নেন।
(iii) জেসুইট নামক নির্বাসিত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের
দেশে ফিরিয়ে এনে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করেন।
ক্ষতিপূরণ: বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের দেশত্যাগী অভিজাতদের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা কৃষকদের বিতরণ করা হয়েছিল। ‘অ্যাক্ট অফ জাস্টিস’ নামে এক আইন পাস করে সেই বাজেয়াপ্ত জমির জন্য অভিজাত ক্ষতিপূরণ
দিতে গিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন।
জুলাই অর্ডিন্যান্স: (i) জুলাই অর্ডিন্যান্স(২৫ শে জুলাই ) জারি করে নির্বাচিত আইনসভা ভেঙ্গে দেন।
(ii) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন।
(iii) বুর্জোয়া
শ্রেণীর ভোটাধিকার কেড়ে নেন।
(iv) অষ্টাদশ লুই -এর
আমলের সনদ বাতিল করেন।
এই অর্ডিন্যান্স ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সে
জুলাই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। বিপ্লবের ব্যাপকতায় সম্রাট দশম চার্লসের পতন ঘটে এবং অরলিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন।
ঐতিহাসিক লিপসন-এর মতে জুলাই
বিপ্লব ফ্রান্সের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে। এই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে
ফ্রান্সের রাজবংশের পরিবর্তন ঘটে, জনসাধারণের লুপ্ত অধিকার ফিরে আসে। জুলাই বিপ্লব ফ্রান্সের এক নতুন সকালের সূচনা করে।
ভিয়েনা সম্মেলন
ভুমিকাঃ ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন
লাইপজিগের যুদ্ধে ১৮১৩
খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়ার চতুর্থ শক্তি জোটের কাছে
পরাজিত হয়ে ভূমধ্যসাগরের এলবা দ্বীপে নির্বাসিত হন। নেপোলিয়নের পতনের পর তাঁর প্রতিষ্ঠা করা সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন যে
ইউরোপের আবির্ভাব ঘটবে, কি রূপ নেবে তা স্থির করার জন্যই ডাকা হয়েছিল ভিয়েনা সম্মেলন। ঐতিহাসিক হ্যাজেন এই
সম্মেলন সম্পর্কে বলেন যে, “ভিয়েনা সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধি সংখ্যা, আলোচিত
সমস্যাবলির জটিলতা, ব্যাপকতা, গুরুত্ব প্রভৃতির বিচারে এটি ছিল ইউরোপের ইতিহাসের
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সমাবেশ।
ভিয়েনা সম্মেলনে উপস্থিত সদস্য ও ভিয়েনা সম্মেলনের স্থান এবং
উদ্দেশ্য: ১৮১৪ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ইউরোপের রাজনীতিবিদরা অস্ট্রিয়ার
রাজধানী ভিয়েনা শহরে সমবেত হতে শুরু করলেও ইউরোপের পুনর্গঠন এর কাজ কিন্তু নির্বিঘ্নে
ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়নি। অনেক ঐতিহাসিক ভিয়েনা সম্মেলন কে প্রকৃত অর্থে সম্মেলন বলে
মেনে নিতে রাজি নয় কারণ তারা বলেন যদিও তুরস্ক ও রোমের পোপ ছাড়া ইউরোপের সমস্ত দেশের
প্রতিনিধি এতে অংশ নিয়েছিল কিন্তু চারটি বৃহৎ রাষ্ট্র অর্থাৎ অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড ও রাশিয়ার হাতেই
ছিল সমস্ত ক্ষমতা। অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা শোভাবর্ধন ছাড়া অন্য কোন কিছু
করেনি। ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এই সম্মেলনের সম্পাদক ফ্রিডারিক ফন
জেনত্শ বলেন যে, “বিজয়ের ফসল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ায় ছিল এই সম্মেলনের প্রধান
উদ্দেশ্য”। তবে
নেপোলিয়ান পরাজিত হলেও পঞ্চম শক্তি হিসাবে ফ্রান্সের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভিয়েনা সম্মেলন জাতি বা দেশ হিসাবে ফ্রান্সকে নয়, ব্যক্তি নেপোলিয়নকে প্রধান শত্রু
বলে মনে করত। কাজেই
ফ্রান্সকে এই সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিতে কেউ আপত্তি করেনি। পরাজিত শক্তিকে এইভাবে ভিয়েনা
সমাবেশে একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান দিয়ে এবং তার উপর উদার ও সহজ শর্তাবলী আরোপ করে বিজয়ী
রাষ্ট্রগুলি একটি অসাধারণ বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
ভিয়েনা সম্মেলনের
প্রাণপুরুষ ছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর প্রিন্স মেটারনিক। সুদর্শন ও চতুর কূটনীতিবিদ
মেটারনিকের লক্ষ্য ছিল অস্ট্রিয়ার স্বার্থ রক্ষা করা এবং সেই জন্য ইউরোপে একটি রক্ষণশীল ব্যবস্থা
গড়ে তোলা। তাছাড়া
ইউরোপের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখাও ছিল তাঁর সুচিন্তিত পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিক
কেটেলবি বলেছেন যে, “ মাছ যেমন ঘূর্ণিজলে অবাধে চলাফেরা করে, তেমনি ভিয়েনা
সম্মেলনের কূটনৈতিক ঘূর্ণিজলে মেটারনিক অনায়াসে বিচরণ করতেন”। লক্ষ্য করার
বিষয় নেপোলিয়নের
পতনের অস্ট্রিয়ার অবদান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য না হলেও সম্মেলনের অধিবেশন বসেছিল ভিয়েনায়। রাশিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে
ভিয়েনায় উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং রুশ জার প্রথম আলেকজান্ডার। পোল্যান্ডে রাশিয়ার প্রাধান্য
বিস্তার-এ তাঁর নীতি
ছিল কঠোরভাবে বাস্তব।
সম্মেলনে ইংল্যান্ডের প্রকৃত স্বার্থঃ ইংল্যান্ড নিজ দেশে কিছুটা উদারনৈতিকতা ও প্রগতিশীলতার
পরিচয় দিলেও ভিয়েনায় রক্ষণশীল নীতি অনুসরণ করেছিল। ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসাবে
উপস্থিত ছিলেন ক্যাশারলিগ ও
ডিউক অব ওয়েলিংটন। ভুতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী পিটের মতো তারাও মনে করতেন
ইউরোপে শক্তিসাম্য রক্ষা করা ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র
নীতির মূল লক্ষ্য। বাণিজ্যিক স্বার্থে তা ইংল্যান্ডের পক্ষে জরুরি ছিল।
সম্মেলনে প্রাসিয়ার ভূমিকাঃ প্রাশিয়ার রাজা তৃতীয় ফেডারিক উইলিয়াম স্বয়ং ভিয়েনায় উপস্থিত থাকলেও প্রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন
হার্ডেনবার্গ।
তাঁর সঙ্গী
ছিলেন হামবোল্ড। তবে
ভিয়েনা সম্মেলনে প্রাসিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বা উল্লেখযোগ্য ছিল না।
পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্বঃ পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি
হিসাবে উপস্থিত ছিলেন টেলিরেন্ড। পরাজিত রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা সহজ কাজ ছিল না। নিজের দায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতা
সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। উপস্থিত রাষ্ট্রনায়কদের তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন যে প্যারিসের
চুক্তি সম্পাদনের পর এবং ফ্রান্সের বুর্বো রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ফ্রান্সের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য
প্রধান রাষ্ট্রগুলির অবস্থানগত কোন তফাৎ নেই। পোল্যান্ড ও সাক্সনীকে কেন্দ্র করে বৃহৎ রাষ্ট্র
গুলির মধ্যে যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল তাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে টেলিরেন্ড তাঁর কূটনৈতিক উপস্থিতির প্রমাণ
দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ম্যারিয়ট-এর মতে, “ভিয়েনা সম্মেলনের এই মর্যাদাপূর্ণ
ও ফ্রান্সের স্বার্থের পক্ষে সহায়ক ভূমিকার কথা চিন্তা করেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর
প্যারিসের শান্তি সম্মেলন পরাজিত হন জার্মানিকে কোন স্থান দেওয়া হয়নি”।
ইউরোপ গঠনের তিনটি নীতিঃ ১৮১৫ সালে যে নতুন ইউরোপের জন্ম
হয়েছিল তার ভিত্তি ছিল তিনটি সুনির্দিষ্ট নীতি। নীতি গুলি হল- বৈধাধিকার নীতি, শক্তিসাম্য নীতি ও ক্ষতিপূরণ
নীতি। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেছেন যে, “ভিয়েনা সম্মেলনে বিজয়ী শক্তিগুলি প্রথমে
নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং পরে সম্মেলনের তিনটি নীতি প্রয়োগ করে”।
বৈধাধিকার নীতিঃ বৈধাধিকার নীতির সবচেয়ে জোরালো সমর্থক ছিলেন
টেলিরেন্ড।
মেটারনিক এই নীতির পক্ষে ছিলেন। এই নীতির মূল কথা হলো যে সব রাজা ও শাসককে নেপোলিয়ান ক্ষমতা
চ্যুত করেছিলেন, তাদের হৃত ক্ষমতা ও সিংহাসন ফিরিয়ে
দেওয়া। এব্যাপারে ঐতিহাসিক গর্ডন ক্লেইগ ন্যায্য বৈধাধিকার নীতির ব্যাখ্যা করে
বলেছেন যে, “নেপোলিয়নের আগে যে সব বংশানুক্রমিক রাজা ছিলেন, তাঁরা যদি নেপোলিয়নের
দ্বারা সিংহাসন চ্যুত হন , তবে বৈধাধিকার নীতির মেনে তাঁদের সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া
হবে’। এই
নীতি অনুসারে অষ্টাদশ লুই ফ্রান্সের সিংহাসন ফিরে পেয়েছিলেন। নেপলস্, সিসিলি ও স্পেনে
বুর্বো রাজবংশ
পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সার্ডিনিয়া পিডমেন্টে স্যাভয় বংশ ও হল্যান্ডে অরেঞ্জ
বংশ আবার ক্ষমতাসীন হয়েছিল। পোপও তাঁর রাজ্য ফিরে পান।
শক্তিসাম্য নীতি: শক্তিসাম্য নীতি অর্থ হলো ইউরোপকে এমনভাবে
ঢেলে সাজানো যাতে অদূর ভবিষ্যতে ফ্রান্সের মত কোন একটি দেশ বা নেপোলিয়নের
মতো কোনো একজন ব্যক্তির একাধিপত্য ইউরোপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হয়। ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির শক্তি বৃদ্ধি করা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের
শক্তি খর্ব করা। এই
উদ্দেশ্যে হল্যান্ডের সঙ্গে লুক্সেমবার্গ ও অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ড বা বেলজিয়ামকে
জুড়ে দেওয়া হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় জেনোয়া। প্রাশিয়াকে দেয়া হয় রাইনল্যান্ড। সুইজারল্যান্ডকে নিরপেক্ষ
দেশ বলে ঘোষণা করা হয়।
ক্ষতিপূরণ নীতি: ক্ষতিপূরণ নীতি বলতে বোঝায় নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ও সংগ্রামে যেসব দেশ অংশ নিয়েছিল ও যেসব দেশের ক্ষতি হয়েছিল, তাদের পুরস্কৃত করা এবং
অন্যদিকে যেসব দেশ নেপোলিয়ানের
পক্ষে ছিল বা তাকে
সাহায্য করেছিল, তাদের
শাস্তির ব্যবস্থা করা। তাছাড়া ইউরোপের পুনর্গঠন এর ফলে যেসব রাজ্যকে তার রাজ্যাংশ অন্য কোন রাষ্ট্রের কাছে
ছাড়তে হয়েছিল, তাদেরও
তার জন্য ক্ষতিপূরণ দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এই নীতি অনুসারে । এই নীতি অনুসারে
অস্ট্রিয়াকে অস্ট্রিয়ান
নেদারলান্ডস জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে লোম্বার্ডি ও ভিনেসিয়া দেওয়া হয়েছিল। নেপোলিয়ানের আক্রমণের আগে
পোল্যান্ডের যে অংশ অষ্ট্রিয়ার পক্ষে
ছিল, তা সে ফিরে পায়। বাল্টিক অঞ্চল-এ নরওয়েকে ডেনমার্কের কাছ
থেকে বিচ্ছিন্ন করে সুইডেনকে দেওয়া হয়। ডেনমার্ক নেপোলিয়নের সঙ্গে মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ ছিল ও তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল বলে
তাকে এই ভাবে শায়েস্তা করা হয়। আবার সুইডেন প্রাশিয়াকে পোমেরেনিয়া ছেড়ে দেওয়াই, তার ক্ষতিপূরণ হিসাবে নরওয়ে পেয়েছিল। একইভাবে পোল্যান্ডে প্রাশিয়ার যা ক্ষতি হয়েছিল
তা পূরণ করার জন্য তাকে প্রায় অর্ধেক সাক্সনী দিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য প্রাসিয়ার ইচ্ছা ছিল গোটা সাক্সনী দখল করা। ক্ষতিপূরণ হিসাবে রাশিয়া
নিয়েছিল পোল্যান্ডের সিংহভাগ। তাছাড়া সে তুরস্কের কাছ থেকে পেয়েছিল বেসারাবিয়া এবং বাল্টিক অঞ্চলে ফিনল্যান্ড। ক্ষতিপূরণ হিসাবে ইংল্যান্ড ইউরোপের
কিছু চাইনি কিন্তু সে উত্তর সাগরে হেলিগোল্যান্ড, ভূমধ্যসাগরে মাল্টা, ভারত মহাসাগরে উত্তমাশা
অন্তরীপ, মরিশাস
ও সিংহল এবং আটলান্টিক মহাসাগরে টোবাগো ও সান্টালুইসার উপর তার অধিকার অক্ষুন্ন রাখে।
তিনটি নীতির প্রয়োগের ফলাফলঃ আপাতদৃষ্টিতে ইউরোপের পুনর্গঠন-এর কাজ উপরি উক্ত তিনটি নীতির উপর
ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও আসলে কার্যক্ষেত্রে সবসময়ই নীতি তিনটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা
হয়নি। নেপোলিয়ান
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের বিলোপ ঘটিয়েছিলেন কিন্তু ভিয়েনা সম্মেলনে তার পুনঅভ্যুত্থান ঘটেনি। জেনোয়া ও ভেনিসের প্রজাতান্ত্রিক
সরকারের পুনর্বাসন ঘটেনি। ফ্রান্সের পরাজয় ঘটার আগে জেনোয়া একটি স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক
দেশ ছিল। কিন্তু
ভিয়েনা সম্মেলনে তাকে অস্ট্রিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়। পোল্যান্ড পূর্বাবস্থায় ফিরে আসেনি। সেখানে রাশিয়ান প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক বারট্রান্ড রাসেলের মতে, পোল্যান্ডে বৈধাধিকার অধিকার নীতি প্রয়োগ করার
কোনো সুযোগ ছিল না কারণ সেখানে কোনো বৈধ রাজা ছিল না এবং তার ব্যবচ্ছেদের জন্য
ফ্রান্স দায়ী
ছিল না। আসলে
ভিয়েনা সম্মেলনে বৈধাধিকার বলতে রাজার বিশেষত বৃহৎ রাজপরিবারের অধিকারের কথা বলা হয়েছিল, প্রজা বা জনসাধারণের নয়। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির
স্বার্থে এবং শক্তিসাম্য ও ক্ষতিপূরণ নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে বৈধাধিকার নীতিকে
অনেকসময় অগ্রাহ্য করা হয়েছে। জার্মানিতে শক্তিসাম্য নীতি যথাযথভাবে কার্যকরী করা হয়েছিল। দুটি প্রধান জার্মান রাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া ও প্রাসিয়া কেউই চাইনি জার্মানিতে বৈধাধিকার নীতি অনুসৃত হোক, কারণ তাদের স্বার্থের পরিপন্থী
ছিল। ফলে ছোট জার্মান রাষ্ট্র গুলির ক্ষেত্রে এই নীতি প্রয়োগ
করা হয়নি। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের নেতৃত্বে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা উঠেছিল
কিন্তু মেটারনিক ও দক্ষিণ জার্মানি রাষ্ট্রগুলির বিরোধিতার জন্য তা সম্ভব হয়নি। প্রাশিয়ার রাজা তৃতীয় ফেডারিক
উইলিয়ামও খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। ৩৮ টি পরে ৩৯টি রাজ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল একটি জার্মান রাষ্ট্রসংঘ বা বুন্ড। এর উপরে প্রকান্তরে ও কার্যত অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় জার্মানিতে জাতীয়তাবাদের
উদ্ভব ও সঞ্চার হয়েছিল, তা অবশ্যই বৈধাধিকার নীতির বিরোধী ছিল। আবার ঐক্যবদ্ধ জার্মানি ফ্রান্সের স্বার্থবিরোধী
ছিল। সেইজন্য চতুর রাজনীতিবিদ টেলিরেন্ড জার্মানিতে বৈধাধিকার নীতি প্রয়োগের পক্ষপাতি
ছিলেন। প্রাসিয়ার শক্তি
বৃদ্ধির ভয়ে মেটারনিক
তাকে সমর্থন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে বৈধাধিকার নীতির প্রয়োগ না করে ৩৮টি পরে ৩৯ টি রাজ্যের জার্মান ফেডারেশন
গঠন করে তার ওপর উপর অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য চাপিয়ে দেওয়া হয়। অস্ট্রিয়া ও প্রাসিয়ার মধ্যে বিরোধ ছিল। প্রাসিয়া তার পোল্যান্ডের কিছু অংশ
রাশিয়াকে ছেড়ে দেবার বিনিময়ে গোটা সাক্সনী দাবি করেছিল। কিন্তু অস্ট্রিয়ার আপত্তির
ফলে
সে সাক্সনির অর্ধাংশ
মাত্র পেয়েছিল। সে
অবশ্য রাইন প্রদেশও পেয়েছিল। এই অংশটি না চাইলেও তা পাওয়ার ফলে সে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছিল কারণ
এই অংশের জনগণ ছিল জার্মান জাতিভুক্ত ও জার্মানভাষী। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া
বেভেরিয়ার শক্তি
বৃদ্ধি করে তাকে তার সমর্থক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। সামগ্রিকভাবে জার্মানিতে
অস্ট্রিয়ার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রাসিয়াও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না, তারও রাজ্যসীমা ও শক্তি
যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু সেক্সনী ও অন্যান্য জার্মান রাষ্ট্র গুলির স্বার্থ নিয়ে কোনো ভাবনা
চিন্তা করা হয়নি। ইতালিতেও অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বড় রাষ্ট্র গুলির মধ্যে
দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের সংঘাত অবশ্য শেষ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষির মাধ্যমে দূর
করে একটা মীমাংসা বা আপসে আসা সম্ভব হয়েছিল।
যবনিকায়ঃ ভিয়েনা কংগ্রেসের অনুসৃত
নীতি ও কার্যাবলীকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র মতবৈষম্য আছে। ভিয়েনা সম্মেলনের প্রশংসা
করে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে, এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ইউরোপে একটানা প্রায় ৫০ বছর শান্তি বজায় রাখা।
ঐতিহাসিক সমালোচনাঃ (only for
wbcs history optional & MA student ) ঐতিহাসিক রাইকার
বলেছেন যে, “প্রকৃত অর্থে ভিয়েনা সম্মেলন কোনো সম্মেলন ছিল না। ......... পাঁচটি
বিদেশমন্ত্রীর ছিল এই সম্মেলন”। আবার প্রাসিয়ার সেনাপতি ব্লুকার এই সম্মেলনকে ‘গবাদি পশুর
মেলা’ বলেছেন। অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করেছেন, আবার অনেকে এর নেতাদের সমর্থন করেছেন। ভিয়েনা
সম্মেলনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো- এই যে, এর রচয়িতারা
জাতীয়তাবাদের আদর্শকে অগ্রাহ্য করেছেন। জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ড বা বেলজিয়াম, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি দেশের
মানুষের জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরি অস্বীকার বা উপেক্ষা করা হয়েছিল। এই চুক্তির রচয়িতাদের তাই রক্ষনশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল
বলে নিন্দা করা হয়েছে, এবং তারা ফরাসি বিপ্লব জাতীয়তাবাদ ও উদারনীতিবাদের আদর্শ
থেকে বিচ্যুত হয়ে যুগধর্মকে অবজ্ঞা করেছেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই ধরনের সমালোচনার প্রতিবাদ করেছেন। এব্যাপারে
ঐতিহাসিক গরডন ক্রেইগ মনে করেন যে, “ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্যোক্তারা তখন ফরাসী বিপ্লব
প্রসুত ভাবনাগুলিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ইউরোপে অশান্তি দেখা দিত”। যদিও এই অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে
অসত্য নয় সে কথাও তারা মেনে নিয়েছেন। তাদের যুক্তি হলো সমবেত রাজনীতিবিদগণ ইচ্ছা করে অপরাধ করেননি আসলে জাতীয়তাবাদ ও
উদারনীতি-বাদের মত নতুন
শব্দগুলির অর্থ ও তাৎপর্য তখনই
তারা
উপলব্ধি করতে
পারেননি। ভিয়েনা
সম্মেলনের পক্ষে আরেকটি
যুক্তি হল এর রচয়িতা ইচ্ছা করলেও জাতীয়তাবাদ ও উদারনীতিবাদ অনুসরণ করতে পারতেন না, কারণ আগে থেকেই পারস্পরিক
বোঝাপড়ার মাধ্যমে তারা কিছু সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, যা না মেনে উপায় ছিল না। তাছাড়া বৃহৎ রাষ্ট্র গুলির
মধ্যে স্বার্থের সংঘাত এড়াতে ও দর কষাকষি করতে গিয়ে এইসব আদর্শ তারা অপেক্ষা করতে
বাধ্য হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক
সীম্যান
তাদের সমর্থনে
আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন ১৮১৫ সালের পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ গ্রহণ করা অসম্ভব
ও অনভিপ্রেত ছিল। উদাহরণ
স্বরূপ তিনি বেলজিয়াম ও জার্মানির কথা বলেছেন। বেলজিয়ামের অধিবাসীদের
অনুমতি ছাড়াই যে
তাকে হল্যান্ডের সাথে
যুক্ত করা হয়েছিল, একথা সত্য। কিন্তু তার মতে এ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, কারণ ১৮১৫ সালে স্বাধীন বেলজিয়ামের
অস্তিত্বের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। বিশেষত নেপোলিয়নের প্রত্যাবর্তন ইউরোপে শান্তি ও নিরাপত্তার
প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি করে তুলেছিল। ঐতিহাসিকদের এইসব তর্ক বিতর্ক সত্ত্বেও একটি বক্তব্য কিন্তু সকলেই মেনে
নিয়েছেন -তা হলো, ভিয়েনা সম্মেলনে জাতীয়তাবাদ
উপেক্ষিত হয়েছিল। ভিয়েনা সম্মেলনের পরবর্তী ইউরোপের
ইতিহাস হল এই ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে খেলার ইতিহাস। অন্যদিকে ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি মনে করেন ভিয়েনা সম্মেলন পুরাতনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায হলেও এবং
নতুন মতাদর্শ গুলি অগ্রাহ্য করলেও পুরাতন তন্ত্রের ভালো দিকগুলোকে এর রচয়িতা তুলে
ধরেন।
ভিয়েনা সম্মেলনের
প্রশংসা করে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে, এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
অবদান ইউরোপে একটানা প্রায় ৫০ বছর শান্তি বজায় রাখা। ইউরোপের অধিকাংশ মানুষই
শান্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। ভিয়েনা সম্মেলনের আর একটি মহৎ কাজের জন্য আমাদের অকুণ্ঠ
প্রশংসা দাবি করতে পারে, সেই কাজটি হল দাস ব্যবসার উচ্ছেদ। সেই সঙ্গে আর একটি
ভালো কাজ হল বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীগুলিতে প্রত্যেকের চলাচলের
অবাধ অধিকার দান।
একথা সত্য যে ভিয়েনা সম্মেলনে গড়ে তোলা ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এর রচয়িতাদের
কিছু কিছু কাজও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় কিন্তু সামগ্রিক বিচারে তাদের কৃতিত্ব যথেষ্ট
উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেছেন
যে, “ভিয়েনা সম্মেলন ছিল মোটামুটি ভাবে যুক্তিসংগত ও রাষ্ট্রনীতিজ্ঞমূলক সন্ধি”।
এই সমাবেশ ইউরোপের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল
এবং এর প্রভাব ১৮৩১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এব্যাপারে আমরা ঐতিহাসিক কেটেলবির কথায় বলতে পারি, “পরবর্তীকালের ইউরোপ
ভিয়েনা বন্দোবস্তের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে”। সুতরাং ভিয়েনা
সম্মেলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
Sir history optional er previous year question answer chai
ReplyDelete