ইতিহাস Optional
ফরাসী বিপ্লবের
পূর্বে ফ্রান্সের সমাজ কাঠামো কেমন ছিল ?
ফরাসী বিপ্লবের
পূর্বে ফ্রান্সের সমাজের প্রধান তিনটি ভাগের বর্ণনা দাও।
ভুমিকাঃ আধুনিক সভ্যতার যাত্রাপথের গুরুত্বপূর্ণ মোড় হল ফরাসি বিপ্লব(১৭৮৯খ্রিস্টাব্দ)।
এই বিপ্লব স্বৈরাচারী ফরাসি রাজতন্ত্রের অবসান
ঘটায়। ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র
অর্থাৎ জনগণের শাসন। এই বিপ্লবের
মাধ্যমে স্বাধীনতা সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ প্রচারিত হয়। ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্স ছিল প্রকৃত অর্থেই এক রাজনৈতিক
কারাগার ও ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর । কর ব্যবস্থা
ছিল বৈষম্যমূলক। ফরাসি সমাজ কাঠামোর গরিষ্ঠ অংশ
তৃতীয় সম্প্রদায় ছিল সব থেকে বেশি অবহেলিত। দৈবরাজতন্ত্রের ধারণা প্রচার করে রাজারা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। স্বৈরাচার, ত্রুটিপূর্ণ অর্থনীতি, সামাজিক ক্ষমতার বৈষম্য,
সম্পদ বন্টনে অসম প্রভৃতির বিরুদ্ধে দার্শনিকরা সরব হন। অভিজাতরাও রাজার বিরোধিতা শুরু করেন। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে
প্রভাবিত করে।
বিপ্লবের পূর্বের
সমাজ কাঠামোঃ অষ্টাদশ শতকে ফরাসী সমাজ মূলত তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল।যথা-
প্রথম এস্টেট বা প্রথম সম্প্রদায়, দ্বিতীয় এস্টেট বা দ্বিতীয় সম্প্রদায় এবং তৃতীয়
এস্টেট বা তৃতীয় সম্প্রদায়।
প্রথম এস্টেট বা
প্রথম সম্প্রদায়ঃ ফরাসী সমাজে প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত যাজকরা ছিল প্রবল প্রতাপশালী। তারা বিশেষ কিছু রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় সুবিধা পেত। যাজকরা ছিল আইনের ঊর্ধ্বে। এরা শহর ও গ্রামের স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা
ভোগ করত। সম্পত্তি ভোগ করলেও ‘কন্ট্রাক্ট অব পেইসি’ নামে এক
চুক্তি অনুসারে তারা কেবল ফরাসি রাজাকে এক স্বেচ্ছাকর দিত।
প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার ফরাসীবাসী যাজক সম্প্রদায়
ভুক্ত ছিল। যাজকদের আবার উচ্চতর ও নিম্নতর
দুটি ভাগ ছিল। উচ্চ যাজকরা বিলাসিতা এবং আমোদ-প্রমোদে দিন কাটাতেন। নিম্নতর যাজকদের জীবন যাপন ছিল সাদামাটা।
দ্বিতীয় এস্টেট বা
দ্বিতীয় সম্প্রদায়ঃ ফরাসি সমাজে অভিজাতরা ছিলেন দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। এরা ছিল সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ। প্রশাসনের উচ্চপদ ও বিচারবিভাগের উচ্চপদগুলি ছিল এদের অধিকারে। বংশানুক্রমিকভাবে এরা শাসন ও বিচার ক্ষমতা ভোগ করত। অভিজাতদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার, অর্থাৎ ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১.৩ শতাংশ ।
মর্যাদার প্রতীক হিসেবে অভিজাতরা সর্বত্র
তরবারি ধারণের অধিকার
পেয়েছিলেন। এছাড়াও
এরা নামের আগে লর্ড বা ব্যারন বা মারকুইস খেতাব ব্যবহার করতেন। এদের জন্য
গির্জাতে আসন সংরক্ষিত থাকত। মৃত্যুদণ্ডের
সাজা পেলে এদের ফাঁসির বদলে শিরশ্ছেদ করা হতো। রাজার সভাসদ হিসেবে অভিজাতরা বিশেষ ভাতা পেতেন।
দরবারী অভিজাতঃ অভিজাতরা প্রধানত
দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। অভিজাত
পরিবারে জন্ম নেওয়া সদস্য জন্মসূত্রে অভিজাত নামে পরিচিত হত। এরা সাবেকি অভিজাত, দরবারী অভিজাত, অসিধারী অভিজাত নামেও পরিচিত ছিল। এরা জন্মসূত্রে অভিজাত হওয়ায় গর্ববোধ করত। এদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০০০জন।
কর্মসূত্রে বা পোশাকি অভিজাতঃ অর্থ জোগাড়ের লক্ষ্যে বুরবোঁ বংশের রাজারা তুচ্ছ দামে প্রশাসনিক পদ বিক্রি করতে শুরু করেন। এই পদ ক্রয়কারী ব্যক্তি কর্মসূত্রে বা পোশাকি অভিজাত নামে পরিচিত ছিল। পোশাক
ছিল এদের আভিজাত্যের
প্রতীক। তাই এরা পোশাকি অভিজাত নামে পরিচিত
ছিলেন।
তৃতীয় এস্টেট বা
তৃতীয় সম্প্রদায়ঃ মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি ফরাসীবাসীকে নিয়ে
গড়ে ওঠে তৃতীয় সম্প্রদায়। তৃতীয়
সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন বুর্জোয়া, কৃষক, শ্রমিক প্রমুখ। ফরাসি বিপ্লবের আগে পর্যন্ত ২ কোটি ৫০
লক্ষের মধ্যে ২ কোটি ৪০ লক্ষ ফরাসী ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত।
বুর্জোয়া
শ্রেণিঃ বার্গার শব্দ থেকে বুর্জোয়া শব্দের উৎপত্তি
ঘটেছে। বার্গার শব্দের অর্থ হলো শহরবাসী। প্রকৃত অর্থে ফ্রান্সে বুর্জোয়াদের সকলেই শহরে
থাকতেন না, অনেকে গ্রামেও থাকতেন। বুর্জোয়াদের অনেকেই ছিলেন শিল্পপতি, বণিক, ব্যাংকার, চিকিৎসক, আইনজীবী প্রমুখ। এরা নিজেদের
মেধা এবং সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিত্তবান হয়ে ওঠেন। বুর্জোয়া শ্রেণি আবার উচ্চ-মধ্য নিম্ন এই তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। দ্রব্যমূল্য কমা বা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এদের আয় কমত বা বাড়ত।
বুর্জোয়ারা প্রচুর অর্থের মালিক হলেও সমাজে তেমন মর্যাদা পেতেন না। বলাবাহুল্য বুর্জোয়াসি বলতে ফরাসি বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত
বুর্জোয়াদের বলা হত।
কৃষক ও ভুমিদাসঃ অষ্টাদশ
শতকে ফ্রান্স ছিল একটি কৃষি নির্ভর দেশ। সমগ্র ফ্রান্সের জনসংখ্যার শতকরা ৮০
ভাগেরও বেশী ছিল কৃষক শ্রেণি। এই কৃষকদের মধ্যে শতকরা পাঁচ ভাগ ছিল ভুমিদাস।
ফ্রান্সের কৃষক সমাজের মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাগ ছিল। যথা- স্বাধীন কৃষক, বর্গা বা
ভাগচাষী, প্রান্তিক স্বাধীন কৃষক, ভুমিদাস বা সার্ফ।
শ্রমজীবী মানুষঃ ফ্রান্সের
শ্রমজীবী মানুষ ছিল তৃতীয় সম্প্রদায় ভুক্ত। এদের বেশিরভাগেই
শহরে বাস করতো। খেটে খাওয়া শ্রমিকরা সাঁ কুলোৎ, ব্রা ন্যু- সহ নানা নামে
পরিচিত ছিল। এক্ষেত্রে বলাবাহুল্য যে সাঁ
কুলোৎ বলতে বোঝাত যারা ব্রিচেস
বা লম্বা মোজা পরে না। এই মোজা পড়ার ক্ষমতা ফ্রান্সের শহরগুলির দরিদ্র বাসিন্দাদের ছিল না। তাই তারা শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে নিজেদের সাঁ কুলোৎ বলে পরিচয়
দিতেন। প্রকৃত অর্থে শহরের খেটে খাওয়া
মানুষেরা সাঁ কুলোৎ নামে পরিচিত
ছিল। শহরে শ্রমজীবী
শ্রেণীর মধ্যে নানা ধরনের শ্রমিক ছিল। যথা- রোজ মজুর, মালি, কমিশন
এজেন্ট, ভিস্তিওয়ালা, পরিচারক, পাচক, কোচোয়ান। ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত এদের কাজ করতে হতো। অথচ পরিশ্রম অনুযায়ী এরা বেতন পেত না। একজন শ্রমিক দিনে যা আয় করত তার
শতকরা পঁচাত্তর ভাগই রুটি কিনতে চলে যেত। হেরিং মাছ, শুটকি মাছ এবং সাদা পনির দিয়ে তারা তাদের পেটের খিদে মেটাত। শ্রমিকদের খাদ্য, পোশাক ও বাসস্থানের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা ছিল না। তাই অনেক শ্রমিক পরিবার ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ
করে জীবন চালাত।
Comments
Post a Comment